নোনা পানিতে আটকে পড়া নারী-শিশুর দুর্ভোগ

আজও বিলকিসের স্কুলে যাওয়া হলো না। ঘরের জন্য পানি সংগ্রহ করতে গিয়েছিল। নিজের গ্রাম চকবার থেকে হেঁটে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বুড়িগোয়ালিনিতে। গ্রামগুলি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের অর্ন্তগত। বিলকিস একা নয়। নারী ও শিশুসহ প্রায় ২৫ জন অনেকে আবার ভ্যাগগাড়ি করে যায়। বিলকিসও মাঝে মধ্যে ভ্যানগাড়িতে যায়। আজ বিলকিসকে হেঁটে যেতে হয়েছে। পানি নিয়ে ফিরে আসতে দ্বিপ্রহর হয়ে যাবে। তাই আজ আর স্কুলে যাওয়া হবে না।

গত ২৯ডিসেম্বর ২০২১ সরেজমিনে গিয়ে দেখা হয় প্রতাপনগর গ্রামের অশতিপর বৃদ্ধা মোহর আলী সাথে তিনি বলেন, “ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আট মাস পর সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর চরিত্র পাল্টেছে। জোয়ারে এখন পানি আরও তীব্র বেগে ছুটে আসে। জলো”ছ¡াসের উ”চতা বেড়েছে আর সেই সঙ্গে পাল্লা নিয়ে বাড়ছে লবণাক্ততা।” ২নং জেলেখানির বাসিন্দা সাবিত্রী রানী বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন জোয়ারের সময় আমার ঘরের মধ্যে পানি উঠে যায়। ভাটায় নেমে যায়এভাবে জীবন চলছে।”

একই ইউনিয়নের সোরা গ্রামের জিন্নাত জাহান ছয় কিলোমিটার দূরের জেলেখানি এলাকা থেকে পানির নৌকা নিয়ে ফিরলেন। নৌকা ভাড়াই ২০০টাকা। ১০টি পরিবারের ড্রাম নিয়ে গিয়েছিলেন। ড্রাম প্রতি ভাড়া ২০টাকা আর প্রতি ড্রাম পানির জন্য আরো ১৫টাকা। সবমিলিয়ে ২০লিটার পানি কিনতে হয়েছে ৩৫টাকায়। খলিশাবুনিয়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ বেহুলাবিবি। চলতে ফিরতে কষ্ট হয় তার ভীষণ। তবু রেশণিং পানি আনতে যায়। ধুমঘাট গ্রামের অব¯’াসম্পন্ন ঘরের বেলিবালা বলেন, “পুকুরের পানিতে এতো লবন যে পানি পান করার অল্পসময়ের মধ্যে ডায়রিয়ার দেখা দেয়। আমার ১৭টি গরু সর্বক্ষণ বেঁধে রাখতে হয় দূষিত পানি যেন পান করতে না পারে; নিরীহ গবাদি পশুগুলোর পানির জন্য ছটফট করা দেখে কষ্ট হয় তবু পানির অভাবে পানি দিতে পারছিনা।”

সাতক্ষীরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত বৈদ্য বলেন,“ বিশুদ্ধ পানির হাহাকার সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাগুনি উপজেলার বির্স্তীণ উপকূল জুড়ে। লবণাক্ততর কারণে এ অঞ্চলে খাবার পানির আকাল গত ২০বছরের তবে ২০০৯ সালে আইলার পর পরি¯ি’তি আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ইউনিয়নে গ্রামের সংখ্যা ১৯টি তার মধ্যে সফলভাবে নলকূপ বসানো হয়েছিলো ৪টি গ্রামে বাকি ১১টি গ্রামে নলকূপে খাওয়ার যোগ্য পানি উঠেনি। তারা সবাই পুকুরের পানি পান করতো। গোটা ইউনিয়নে পুকুর ছিলো ৪২টি। আইলার পর ৪০টি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে দু’একটি সচল নলকূপ এবং সরকারি বেসরকারি রেশনিং এর পানিতেই বেঁচে আছে এই ইউনিয়নের মানুষগুলি। পরিবারের পুরুষেরা কাজে ব্যস্ত থাকায় পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে নারী ও শিশুদের।”

সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোহাম্মাদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সমস্যা মোকাবেলায় সাধ্যের সর্বো”চ ব্যবহার করে কাজ করছে জেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ। সহযোগী হিসেবে কাজ করছে স্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন। আইলার পরপরই উপদ্রুত অঞ্চলের পুকুরের পানি শোধন প্রকল্প, এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার পদ্ধতিগুলি সংস্কার করা হয়েছিলো। যে কারণে শুরুতে সংকট অতো তীব্র হয়নি। ওই অঞ্চলকে আমরা বেশি লবণাক্ত হিসেবে চিহিৃত করেছি। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পুকুর খনন করা হচ্ছে। আইলা,ইয়াস,আম্পানের পর শুস্ক মৌসুমে পুকুরের পানি অতিমাত্রায় লবণাক্ত হওয়ায় পান করতে হয়েছে ধরে রাখা বৃষ্টির পানি আর সেই ধরে রাখা পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় সংকট তীব্রতর হয়েছে।”

এনভয়নমেন্টাল লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “দুর্যোগ মোকাবিলায় পানি অবকাঠামোগুলোর কার্যকারিতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩তে জনগনের অধিকার বঞ্চনার বিষয়ে জবাবদিহিতার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের কোনো মতামতও প্রতিফলিত হয়নি। এই আইন পাস করার আগে জনগনের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিলো। কিনতু বন্যাদূর্গত উপকূলের মানুষ, পার্বত্য চট্রগ্রামের মানুষ তো ইন্টারনেট অ্যাকসেস করতে পারেনি তাই তারা তাদের মতামত প্রদান করতে পারেনি।” বেলার আরেক আইনজীবী ইকবাল করিম বলেন,“ পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পানি পাওয়া একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে জাতীয় পানিনীতি-১৯৯৯ এ ২০১২ সালের খসড়া নীতিমালয় স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ তে বিষয়টি সর্র্ম্পূণভাবে অনুপস্থিত। এ কারণে প্রনীত এ আইনে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পানি পাওয়াকে ‘অধিকার’ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় আইনটি জনস্বার্থে রক্ষায় দারুণভাবে ব্যর্থ হবে।”

ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউর (আইআরভি) নির্বাহী পরিচালক মেরিনা যুথী বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির্পূণ দক্ষিন-পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলের অন্যতম একটি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা কয়রা। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে এখানকার নারীরা চর্মরোগ, উ”চ রক্তচাপ, বাতের ব্যথা,গর্ভকালীন সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হন। কিন্তু স্বল্প আয় ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দূরে থাকায় তারা খুব সহজে যেতে পারেন না। স্বাস্থ্যকর্মীরাও কখনো তাদের গ্রামে তেমন যায়না। কিন্তু এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত নারীদের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সংযুক্ত করতে হবে।” উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, “২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত জলবায়ু অভিযোগজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) বাস্তবায়নাধীন ৮৩টি প্রকল্পের মধ্যে একটি প্রকল্প সরাসরি নারী ও শিশুদের সঙ্গে সর্ম্পক যুক্ত। “পরিবেশগত নাজুক এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ নারী শিশুদের জন্য” পানি সরবরাহ ও সামাজিক সুরক্ষা” নামক একটি প্রকল্প মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধু ভোলা জেলায় বাস্তবায়ন করছে। ভোলার সঙ্গে খুলনা সাত্ক্ষীরা বাগেরহাটসহ অন্যান্য উপকুলীয় জেলাতেও এই প্রকল্প চালু করা প্রয়োজন।”

বর্তমান বাস্তবতায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবে সহনশীলতার চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে যা”েছন উপকূল অঞ্চলের নারী ও শিশুরা। এক কলসি মিঠা পানি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় জীবন বিপন্ন করে হলেও খেয়াল রাখতে হয়, যেন এক ফোঁটা নোনা পানি কলসিতে মিশে না যায়।