এক বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে জরিনা বেগম কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। হার জিরজিরে শরীর দেখে মনে হয় ছয়মাসের শিশু। মায়ের অবস্থাও একই। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পূরবী আহমেদ দেখে জানান, শিশুটি মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। শিশুকে বুকের দুধ দিয়েছেন কীনা জানতে চাইলে জরিনা বেগম জানান, বুকের দুধ পায়নি। কৌটার দুধ কিনে খাইয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ে গ্রামগুলো থেকে আসা রোগীদের বেশির ভাগই অসচেতন, অজ্ঞ ও শিক্ষার হারও কম। এসব শিশু রোগীর প্রধান সমস্যা পুষ্টিহীনতা। জটিল অবস্থায় পৌঁছানো পর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসে। অনেক মা গর্ভকালীন অবস্থায় পুষ্টিকর খাবার ও সঠিক পরিচর্যা পায়নি। ফলে গর্ভের শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে।
মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে খাদ্য অন্যতম। কিন্তু পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য লড়াই করতে হয়। পুষ্টিস্বল্পতা বিশ্বব্যাপী একটি সর্বজনীন সমস্যা হলেও, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের প্রধান কয়েকটি সমস্যার মধ্যে অপুষ্টি অন্যতম। এ সমস্যা গ্রাম-শহর, উচ্চবিত্ত-নি¤œবিত্ত সর্বত্র বিরাজমান। গ্রামের মানুষের উপার্জন কম, তাই পুষ্টিযুক্ত খাদ্যের প্রাপ্যতা কম। আবার অনেকেরই পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। তাই পুষ্টিস্বল্পতায় ভোগে। শিশুর জন্মোত্তর পুষ্টির সঙ্গে তার জন্মপরবর্তী পুষ্টির ব্যাপারটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থানকালে মায়ের পুষ্টিই শিশুর পুষ্টিলাভের উৎস। গর্ভবর্তী মায়ের পুষ্টিলাভ ব্যাহত হলে তার গর্ভস্থ শিশুটিও এর প্রভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই গর্ভবতী মায়ের অপুষ্টি গর্ভস্থ শিশুর অপুষ্টির মূল কারণ। আয়োডিনের অভাব, কম ক্যালরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ গর্ভবতী মায়ের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। পুষ্টিহীন প্রসূতি কমওজনের শিশুর জন্ম দিতে পারে। তারপর পুষ্টিহীনতার ধারাবাহিক পর্ব শুরু হয়ে প্রজন্ম পরম্পরায় অব্যাহত থাকে। পুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুটি যখন জীবনের যাত্রা শুরু করে তখন একটি ধারাবাহিক রুগ্ন অভিযাত্রার সূচনা হয়। তাই শিশুর অপুষ্টি সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা।
বাংলাদেশে এখনও বহু শিশু অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণও অপুষ্টি। দেশের ৫ লক্ষাধিক শিশুর জীবন প্রতিবছর ঝুঁকির মধ্যে থাকে, যার মূলে রয়েছে অপুষ্টি। গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যা আরো বেশি। বাল্যবিবাহের কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরাও সন্তান প্রসব করে। এসব সন্তানের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে। সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবারের অভাবেও শিশুরা পুষ্টিহীনতার জন্য সমানভাবে দায়ী। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের অপুষ্টির বলয় থেকে বেরিয়ে আসা বেশ মুশকিল। খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোতে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা বেড়েছে। দেশের সামগ্রিক পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ ২০১১ সালে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) প্রকাশ করে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) পরিচালিত এ জরিপে বলা হয়, গত চারবছরে বাংলাদেশের পুষ্টিপরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ মোঃ মহসিন আলী বলেন, ‘বাংলাদেশে যত শিশু মারা যায়, তার প্রায় ৫০ ভাগ মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পূর্ণবয়সে কর্মক্ষমতা কম হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে না।
মাতৃদুগ্ধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জন্মের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শিশুর একমাত্র খাবার মায়ে বুকের দুধ। এ সময় মায়ের দুধ ছাড়া বিকল্প কোনো খাদ্যের দরকার নেই। তবে ছয়মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ পানের হার এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এক্ষেত্রে অল্পবয়সে সন্তান প্রসবের ফলে শিশুর মায়ের দুধ ঠিকমতো না পাওয়া, মায়ের দুধের উপকারিতা সম্পর্কে প্রচার কার্যক্রমের অভাব, মায়ের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্যের প্রচার বেশি পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়ায়। অসচেতনতার কারণেও অনেক মায়েরা শিশুদের বুকের দুধ ঠিকমতো পান করাতে চায় না। আবার কর্মজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে ব্যস্ততার কারণে শিশুরা মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। যে সব শিশু ছয়মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পায়নি তারা ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও অপুষ্টিতে বেশি ভোগে।
বর্তমানে দেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ। তার মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ শিশু কমবেশি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে অপুষ্টিতে ভোগে ৪০ জন শিশু। দেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে ষষ্ঠ জনমিতি ও স্বাস্থ্য পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ বিশ্বক্ষুধা পরিস্থিতি সূচক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমলেও শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার এখনও উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। গত পাঁচবছরে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়নি। তবে পুষ্টি পরিস্থিতি সার্বিকভাবে অগ্রগতি হয়েছে। অপুষ্টিজনিত কারণে দেশে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ২ জন স্বাভাবিক গড়নের চেয়ে খর্বকায়। বর্তমানে ৪১ ভাগ শিশু খর্বাকৃতির। তবে বিডিএইচএস-২০১১ এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, সিলেটে খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা সবেচেয়ে বেশি ৪৯ ভাগ পর্যন্ত। আর যেসব পরিবারের মায়েরা অশিক্ষিত, অজ্ঞ সেসব পরিবারে খর্বাকৃতি শিশুর হার আরো বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামে শিশুরা খর্বাকৃতির সমস্যায় বেশি ভুগছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর শিশুরা বিশেষ করে সেসব অঞ্চলের বা পরিবারের শিশুরা মারাত্মক খর্বাকৃতির, কৃশাকায় অথবা বয়সের তুলনায় কমওজনের তাদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। উল্লেখ্য অনুন্নত গ্রামাঞ্চলে প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মধ্যে সরকার দুপুরে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বিতরণ করছে।
সুস্থজাতি গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থশিশু। শিশুকে সুস্থ রাখতে হলে দরকার তার পুষ্টির চাহিদা পূরণ। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা অনেক কমেছে। সেই তুলনায় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এখনও অঞ্চলভেদে বহুমানুষ প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশুর শারীরিক গঠনে। শিশুর সুস্বাস্থ্য গঠনে পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব অনেক। আবার শিশুর সুস্থতার জন্য সবার আগে মায়েদের কথা ভাবতে হবে। মা যদি সুস্থ থাকে ও পুষ্টিসম্পন্ন খাবার গ্রহণ করে তাহলে মায়ের গর্ভে থাকা শিশুটিও ভালো থাকবে। একটি সুস্থ মা-ই পারে একটি সুস্থজাতি উপহার দিতে।
সাম্প্রতিককালে দরিদ্র হ্রাসে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। গত সাড়ে তিনবছরে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ কমেছে। অপুষ্টির হার ৪২ ভাগ থেকে ৩৬ ভাগে হ্রাস পেয়েছে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সে কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৯০ সালে এমডিজির সূচনায় বাংলাদেশে কমওজনের শিশুর সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে ৭১ থেকে ৩৩ ভাগে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে।
বিশ্বের মোট অপুষ্টিজনিত শিশুর মধ্যে ৭০ ভাগের বাস এশিয়ায়। গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে প্রতি তিনজন নারীর একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। তারা রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টি নিয়ে গর্ভবতী হয়। ফলে গর্ভের শিশু সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্ম হয়। তারপর তা চক্রাকারে চলতে থাকে। অপুষ্টি দূরীকরণের কাজটি সহজ নয় কিংবা রাতারাতিও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কৃষি উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ খাবার পানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ইত্যাদি এর সাথে জড়িত।
আমাদের দেশে দরিদ্রের চেয়েও অসচেতনতাই অপুষ্টির জন্য বেশি দায়ী। বাংলাদেশ এখন শাক-সবজি এবং মাছ-মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অনেকেই আছেন দেশীয় শাকসবজি ও ফলমূলের চেয়ে বিদেশি ফলমূলের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। দেশের আনাচেকানাচে বহু শাকসবজি ও ফলমূল রয়েছে যা দামে সস্তা এবং সহজেই পাওয়া যায়। একটু সচেতন হলেই এসব ফলমূল খেয়ে পুষ্টির অভাব পূরণ করা যায়। তাই সবার উচিত পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন হয়ে পুষ্টিহীনতার অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করা।