পরিকল্পিত মা ও শিশুর স্বাস্থ্য

জনবহুল ও ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশে। দেশে সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয় অভাবে গ্রাম তথা শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যেমন ভোগ করে অপুষ্টিতে, তেমনি নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে। জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুরা শতকরা ৬৫ ভাগ অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে। আজকের শিশুটি বড় হয়ে সমাজ ও দেশের দিশারি হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের থাকে এক অনাগত স্বপ্ন। দুর্দিনে সংসারে হাল ধরবে এ প্রত্যাশা সব অভিভাবকই পোষণ করেন। কিন্তু আমাদের দেশের মায়েদের পুষ্টিজ্ঞানের অভাব ও অভিভাবকদের অর্থনৈতিক দৈন্যতার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার জন্য ৯০ শতাংশের এর বেশি শিশু অপুষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। অপুষ্টি হচ্ছে সাধারণত অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ এবং রোগ সংক্রমণের সম্মিলিতকাল। বয়স অনুযায়ী শিশুদের ওজন ও উচ্চতা যতটা হওয়া উচিত, অপুষ্টিগ্রস্ত শিশুদের ক্ষেত্রে তা অপেক্ষাকৃত কম হয়ে থাকে। ওজন ও উচ্চতা পরিমাণ হচ্ছে জনসংখ্যার অপুষ্টির মাত্রা নিরূপণের সবচেয়ে সাধারণ উপায়। বিশ্বে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ অপুষ্টিজনিত মৃত্যু। তা ছাড়াও ডায়রিয়া নিউমনিয়া হাম এবং ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশু অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগে। অপরিমিত খাদ্যভ্যাসের মধ্যে রয়েছে শিশুকে অপর্যাপ্ত বুকের দুধ খাওয়ানো, শিশুর অপর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য প্রদান এবং শিশুর পুষ্টি সাধনে সম্যক ধারণার অভাব।

পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা ছয়টি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। ঘাতক রোগগুলো হচ্ছেÑহাম, যক্ষ্মা, পোলিও, ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়াও হুপিং কাশি। শিশুর দেহে লোহা ক্যালসিয়াম, আয়োডিনের অভাব হলে অপুষ্টি দেখা দেয়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, ‘এক বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর দৈনিক ক্যালসিয়ামের চাহিদা ০.৫-০.৬ গ্রাম। ক্যালসিয়ামের সঙ্গে ফসফরাসের চাহিদা সম্পর্কযুক্ত। ফসফরাসের চাহিদা ক্যালসিয়ামের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। জন্মের পরে ১২ মাস পর্যন্ত শিশুর লোহার চাহিদা প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১ মিলিগ্রাম। সে জন্য শিশুকে দুধ, ডিম কলিজা ও মাংস এ জাতীয় প্রাণিজ প্রোটিন দেওয়া উচিত। আয়োডিনযুক্ত খুব সামান্য লবণও শিশুর খাদ্যে থাকা প্রয়োজন।’

মেধা বিকাশের জন্য দুই থেকে পাঁচ বছর শিশুদের বেশি করে ডিমের কুসুম খাওয়ানো উচিত। গর্ভকালে মাকে পুষ্টিকর খাবার খেতে না দিলে সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বামনাকৃতি, হাবা, ট্যারা শিশুর জন্মের সম্ভাবনা থাকে। বাল্যবিবাহ আমাদের দেশে আরেকটি সমস্যা। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫-২১ বছর বয়সে যেসব মেয়ের বিয়ে হয় তাদের মধ্যে বিকলাঙ্গ সন্তানদানের প্রবণতা বেশি এবং মৃত্যুহারও বেশি। কাজেই বাল্যবিবাহও বন্ধ করে অবশ্যই বয়স বৃদ্ধি করতে হবে এবং এই ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।

পোলিও টিকার চতুর্থ ডোজ হামের টিকার সঙ্গে দিতে হবে। শিশুদের প্রতিষেধক ছয়টি টিকা দিলে ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধুনষ্টংকার, পোলিও, যক্ষ্মা, ওহামÑছয়টি সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তবে, শিশুর ছয় সপ্তাহ বয়স থেকেই প্রথম ডোজ টিকা দিতে হবে। ডিপিটি ও পোলিওর টিকা অন্তত এক মাস পর তিনবার দিতে হবে। জন্মের পরেই বিসিজি টিকা দেওয়া যায়। সঠিক সময়ে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে দেরি করা যাবে না। বিসিজি টিকা দেওয়ার তিন সপ্তাহ পর টিকার জায়গায় ঘা হবে। এতে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। টিকার স্থানে কোনো ধরনের ওষুধ লাগাতে হবে না। কিছুদিন এমনিতে ঘা সেরে যাবে। নয় মাস বয়স পূর্ণ হলেই শিশুকে হামের টিকা দিতে হবে। টিকা দেওয়ার পর সামান্য জ্বর হলে অস্থিরতার কারণ নেই। শিশুকে ভিটামিন এ খাওয়াতে হবে। এই ব্যাপারে সরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মাঠকর্মীরা শিশুদের বয়স অনুসারে নির্ধারিত মাত্রায় ভিটামিন বিনা মূল্যে বিতরণ করে থাকে।

বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ লাখেরও বেশি শিশু মারা যায়। এর নেপথ্যে আছে মায়ের গর্ভকালে স্বাস্থ্যহানি, জটিল রোগ-ব্যাধির প্রকোপ সুষম খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব পরিবেশ অশিক্ষা কুসংস্কার ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি রয়েছে পুষ্টিহীনতা দারিদ্র্য অর্থনৈতিক সমস্যা ও অজ্ঞতা। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করে তার মধ্যে প্রতি পাঁচজন একজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন ও আকারে ছোট হয়। এশিয়ার চারটি দেশে ২ দশমিক ৫ কেজি এবং ৫৫ পাউন্ড ওজনের শিশু জন্ম নেয়। কম ওজন ও ছোট আকারে জন্ম নেওয়া শিশুদের এক থেকে তিন বছরের মধ্যে খিঁচুনি অন্ধত্ব বধিরতা মস্তিষ্কের পক্ষঘাত ও প্রতিবন্ধিত্বে পেয়ে যায়। বাংলাদেশে এ ধরনের শিশু জন্মের হার ৫০ ভাগ।

গর্ভকালীন মায়েদের আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের অভাবে প্রতি বছর বিশ্বে চার কোটি শিশুর মধ্যে এক কোটি প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করেন। ২০০ কোটির বেশি লোক প্রধানত নারী ও শিশু আয়রণ ঘাটতিকবলিত এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউ-এইচও) হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অনূর্ধ্ব চার বছর বয়সী শতকরা ৫১ ভাগ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ ভাগ অঞ্চলে আয়রন ঘাটতিকবলিত দুই বছরের কমবয়সী শিশুদের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্যের অভাব দেখা যায় এবং তাদের অমিশুক ও দ্বিধান্বিত মনে হয়। ৯০-এর দশকে ৪৮টি দেশের গর্ভকালীন মায়েরা আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের ফলে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু বিকলাঙ্গ এবং প্রতিবন্ধিত্ব থেকে রক্ষা পেয়েছে প্রতি বছর বিশ্বে ২০ লাখেরও বেশি শিশু নিউমোনিয়ায আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আধুনিক চিকিৎসা ওষুধের মাধ্যমে ৮৮টি দেশে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ এখনো এ রোগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সংক্রামক ব্যাধি বা নিউমোনিয়া। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর শতকরা চল্লিশ ভাগ শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় আসে এবং তাদের অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করে। জন্মের এক বছরের মধ্যে বিশ্বে ৮০ লাখ শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ শিশু জন্মের চার সপ্তাহের মধ্যে মারা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোয়।

শিশুর শৈশব অবস্থায় তার মায়ের দুধ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। অনেক ক্ষেত্রেই অসুস্থ শিশুর রোগ নিরাময়ে মায়ের দুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুর দেহ গঠনের চাহিদা পূরণ করতে মায়ের দুধের প্রোটিনের প্রয়োজন ১০৬ গ্রাম আর সেই চাহিদা পূরণে গরুর দুধের প্রোটিনের প্রয়োজন হয় দুই গ্রাম। বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছর বয়সী অসংখ্য মৃত্যুবরণকারী শিশুর মধ্যে শতকরা দশ ভাগ শিশু শৈশবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ না পাওয়ায় মারা যায়, ফলে মাতৃদুগ্ধের অভাবে ১৫ লাখ শিশুর জীবনহানি ঘটে। দশ ভাগ শিশু শৈশবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ না পাওয়ায় মারা যায়। হাম প্রতিষেধক টিকা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের পরও সারা বিশ্বে তিন কোটি শিশু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি বছর পাঁচ বছর বয়সের নিচে কমপক্ষে আট লাখ হামে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন হাম আক্রান্ত প্রায় দুই হাজার শিশু প্রাণ হারায়। শিশুর নিরাপদ পরিবেশ স্বাস্থ্য চিকিৎসা খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে, যাতে এর সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশ মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিরাপত্তা বিধান করা যায়। তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে মা ও শিশুর নিরাপদ জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার পঞ্চম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আর্থ-সামাজিক শিক্ষা অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে অবকাঠামোগত পরিকল্পনায় বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসের পাশাপাশি শিশুমৃত্যু হার হ্রাস করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, ধনুষ্টংকারের হাত থেকে শিশু ও মাকে রক্ষা শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান প্রণয়ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। মায়ের গর্ভকালে রোগ প্রতিরোধ করে নিরাপদ বেঁচে থাকা, শিক্ষা চিকিৎসা এবং দারিদ্র্যবিমোচনের মাধ্যমে ২০০৫ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। যেখানে আমাদের দেশে প্রতি মিনিটে পাঁচজন শিশু জন্মগ্রহণ করে, সেখানে মা ও শিশু একে অপরের পরিপূরক। তাই সুস্থ মা-ই পারেন সুস্থ শিশু উপহার দিতে।