এইডস মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সামাজিক অবজ্ঞা ও করুণা গোটা পরিবারকে গ্রাস করে ফেলে। সমাজের সৃষ্ট অবজ্ঞা তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের ঠেলে দিয়েছে হতাশার অন্ধকারে। তারা বেঁচে আছে তবে এ বেঁচে থাকায় কোন প্রান নেই। জীবনের আকুতি নেই”এমন খোদোক্তি প্রকাশ করছিলেন সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা পরিষদ মিলয়াতনে ‘অ্যাডভোেেকসি মিটিং অন এইচআইভি/ এইডস প্রিভেনশন’ শীর্ষক দিনব্যাপি অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দৃষ্টি এইডস আক্রান্ত পয়ত্রিশর্ধ্ব মোমেনা বেগমকে পরিচিতিকালে।
ব্যবসায়ী স্বামী ও দু’সন্তান েিয় সুখের সংসার ছিলো কিন্তু কখন তার শরীরে এ রোগ বাসা বেঁধেছিলো সে জানতে ও বুঝতে পারিনি। তাঁর বড় সন্তানের বয়স ১৩ এবং কোলের ছেলেটির বয়স তিন তবে উভয়ে এইচআইভি মুক্ত। ২০০৪ সালে নভেম্বর মাসের একদিনে হঠাৎ করে জ্বর সাথে ডায়ারিয়া, উপরিক্ত কাশিতে আক্রান্ত হয়ে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হলো। একমাস না যেতেই আবার টাইফয়েড আক্রান্ত হলো। ডাক্তার জানালেনÑ এইডস রোগে আক্রান্ত। এরপর বেসরকারি সংস্থা ‘দৃষ্টি’ সহযোগিতায় সে আশার আলো সোসাইটিতে আশ্রয় পায়। সামাজিক দুয়ো-দুয়ো থেকে মুক্তি পায়। আশার আলো সোসাইটিতে মোমেনা একা নয়Ñ রিতা, সালমা, আসমা, স্মৃতিসহ তাদের সবারই একই নিবেদন পারিবারিক ও সামাজিক অবজ্ঞা অবহেলা থেকে নিষ্কৃতি। মোমেনার দুঃসহ জীবনের বর্ণনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইউপি চেয়ারম্যান,মেম্বার, থানা পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তাগণ ও স্থানীয় দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকবৃন্দ।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আশার আলোর নির্বাহী পরিচালক একেএম আমিনুল রশিদ অবগত করান, তারা এইচআইভি আক্রান্ত ১৩৯ জন রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন। এর মধ্যে ৪০ জন নারী, ৯৩ জন পুরুষ ও ৬ জন শিশু এদের বয়স ২ বছর থেকে ১১ বছর, প্রত্যেকই পিতা কিংবা মাতার কতৃর্ক আক্রান্ত। এই ৬জন শিশুর পিতাই ছিলো প্রবাসী চাকরিজীবী তবে দু’জন মৃত্যুবরণ করছেন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের এসব শিশুরা বিভিন্নরকম সংকটে আক্রান্ত। মায়েদের সবাই এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। খাদ্য বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারই তাদের পূরণ হচ্ছে না । তার উপর রয়েছে চিকিৎসা বিরাট খরচ। তাছাড়া এসব অবুঝ শিশুরাও সামাজিক জীবনে নিগ্রহের শিকার। এমনকি স্কুল থেকেও বের করে দেয়। সাদিকীন পড়তো ঢাকার মীরপুর এলাকার এক স্কুলে। পিতার মৃত্যু হলে কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে পড়ে তার পিতা এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। পরদিনই সাদিকীনকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। প্রধান শিক্ষিকা তার মাকে ডেকে নিয়ে স্পষ্ট জানান দেন তার ছেলেকে আর স্কুলে রাখা যাবে না।
এইডস রোগীদের চিকিৎসা স¤পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এইডস রোগীদের চিকিৎসা হাসপাতালে হলে রোগী সবদিক থেকেই স্বস্তি পায়। এইডস রোগীর চিকিৎসা খরচও বেশি। একটি ট্যাবলেটের মূল্য প্রায় ৭৪ টাকা। চিকিৎসা খাতে একজনের মাসে খরচ পড়ে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। ব্যক্তিগতভাবে এ খরচ বহন করা অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব নয়। হাসপাতালে চিকিৎসা হলে রোগীর ব্যক্তিগত খরচ কমে যায়। একজন শিশুর চিকিৎসা খাতে মাসে খরচ পড়ে কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। শিশুদের জন্য সিরাপ নেই। তাই ট্যাবলেট মধু মিশিয়ে খেতে হয়। দামও খুব বেশি। বাংলাদেশে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও গণস্বাস্থ্য এইডসের ওষুধ প্রস্তুত করছে।
ডাক্তার নাসিফা আবেদিন জানান, বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা সরকারি হিসাব মতেÑ ১৪ হাজার ৭২৯ জন। বেসরকারি সংগঠনের উপাত্ত অনুযায়ী তিনগুন বেশি হবে। ইউএন এইডস পরিসংখ্যানে হচ্ছে ১৮ হাজার আর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মতে বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ২৩ হাজার। বর্তমানে মহাখালীর সংক্রমক ব্যাধি হাসপাতালে এইডস রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞর মতেÑ উচ্চমূল্যের কারণে বর্তমানে ওষুধটি এখনো আমদানি করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে না। এফডিএ কর্তৃক অনুমোদিত ওষুধগুলোর তালিকা ও মূল্য htt://www.fda.gov/oashi/aids এই ওয়েব সাইটে পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পার্লামেন্ট মেম্বারস সার্পোট গ্রুপ (বিপিএমএসজি) আয়োজিত এইডস প্রতিরোধ এবং মানবপাচার শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এইডস রোগীদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এইডস রোগীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে উত্তরার আব্দুল্লাহপুরস্থ মমতাজ আদর্শ এতিমখানা কর্তৃপক্ষ এইডস আক্রান্ত একজন মায়ের দুটি সুস্থ সন্তানকে ওই এতিমখানায় আশ্রয় দেয়। এদিকে ২০২১ সালে জুন মাসে অনুষ্ঠিত এইচআইভি/এইডস বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বিশেষ অধিবেশেনে বাংলাদেশ অংশগ্রহন করে এবং “ডিক্লারেশন অব কমিউন্টে অন এইচআইভি/এইডস-এর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। এইডস মহামারী মোকাবেলার জন্য মূর বিষয়সমূহ এই ডিক্লারেশন-এ চিহিৃত করা হয়। ‘ডিক্লারেশন অব কমিটমেন্ট অন এইচআইভি/এইডস’-এর অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এবারের বিশ্ব এইডস দিবসকে সামনে রেখে গৃহীত প্রতিপাদ্য বিষয় Stop AIDS, Keep the Promise বাংলায় ‘এইডস প্রতিরোধ আমাদের অঙ্গীকার’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়টি উলেখিত ‘ডিক্লারেশন অব কমিটমেন্ট অন এইচআইভি/এইডস’ এর আলোকে গৃহীত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকার প্রথম থেকেই এইডস রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। এ রোগের ভয়াবহতার প্রতি লক্ষ্য রেখে ১৯৮৫ সালে জাতীয় এইডস কমিটি (NAP) গঠিত হয়েছে এবং অদ্যবধি তা কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জাতীয় এইডস নীতিমালা প্রণীত হয়েছে এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। যার মাধ্যমে এইডস প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম গৃহীত হচ্ছে। এইডস প্রতিরোধে আচরণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে এইডস প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কমপক্ষে ২৪টি এনজিও কাজ করছে। এইডস প্রতিরোধ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাথে অর্থ, ধর্ম, স্বরাষ্ট্র, তথ্য, মহিলা ও শিশু, যুব ও ক্রীড়া শ্রম ও বৈদেশিক কল্যাণ শিক্ষা, সমাজকল্যাণ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। ইতোমধ্যে নিরাপদ রক্তসঞ্চালনের জন্য আইন করা হয়েছে। জেলা সদর, মেডিকেল কলেজ ও বিশোষায়িত হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ৯৭টি কেন্দ্রে HIV ভাইরাস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯৯৮সাল থেকে বিশ্ব এইডস দিবস পালন, এইচআইভি/এইডসের জাতীয় কার্যক্রম গ্রহণ, বিভাগ, উপজেলা সিটি কর্পোরেশন,রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি,পুলিশ বিভাগ, শ্রমিক সংগঠন, সাংবাদিক, যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ প্রদান,টিভি ও রেডিওতে এবং ডবলডেকার বাসে শ্লোগান/বাণী প্রচার। বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস পরিস্থিতি পর্যালোচনা, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ মহামারীর জন্য ঝুঁকিসমূহ এবং এ পর্যন্ত বাস্তবায়িত কার্যক্রমগুলো বিশেষণ করে জাতীয় কর্মকৌশল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে জনগোষ্ঠিকে সেবা ও সহায়তা প্রদান, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি-প্রতিরোধ,স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় নিরাপদ ও নিরাপত্তামূলক কর্মচর্চা বৃদ্ধি, এইচআইভি/ এইডস সংক্রমিতদের জন্য সেবা ও সহায়তা প্রদান ও এইচআইভি/ এইডস মহামারির প্রভাব প্রশমিত করা।
এইচআইভি/এইডস এর বর্তমান অবস্থা সর্ম্পকে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেস ইনসষ্টিটিউট আয়োজিত এইডস প্রতিরোধে সাংবাদিকদের এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, ‘বাংলাদেশ বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক রীতি ও কৃষ্টির কারণে এইচআইভি/এইডস এখনো ব্যাপকতা লাভ করেনি। প্রতিবেশি দেশগুলিতে এইডস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশকে এইচআইভি/এইডস মহামারী থেকে মুক্ত রাখতে সকল স্তরের জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা ও সরকারের সময়োচিত উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন যা আমাদের রয়েছে। এ দুটি শক্তির সমন্বয়ে আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে মহামারি প্রতিরোধের দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে।’