শিশুদের দেহে নিকোটিন সচেতনতা জরুরি

সাদ্দামকে দেখতে উপজেলা হাসপাতালে প্রায় সবাই এসে ভিড় করেছে তার পাড়ার-পড়শিরা। বিশেষ করে তার মা সেতারা বানু রিকশাচালক বাবা ওয়াহিদ মিয়া তো হাউমাউ করে কেঁদে-কেটে হয়রান। কর্তব্যরত ডাক্তারের পা ছুঁয়ে চিৎকার করে বলছিল তার ছেলেকে বাঁচাতে। তা ছাড়া সবার মুখে একই কথা তাকে ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা দেওয়া উচিত। কেউ বলছে, ছেলেটা অনেক দিন ধরে অসুখে ভুগছে। কেউ বলছে, তার চলাফেরা খাওয়া-দাওয়া এমনকি কাজকর্মে অমনোযোগ লক্ষ করা গেছে। কেউ বলছে, মনে হয় জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। পথে-ঘাটে, ট্রেনে-বাসে পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রেতা তওফিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আজ সাত দিন। এক সকালে বাসে ওঠে পান-সিগারেট বিক্রির সময় হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। লোকজন ধরাধরি করে গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়ে দেন। কুমিল্লার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড-লাগোয়া তাদের বাড়ি। খবর পেয়ে যান ঘণ্টার মধ্যে তার পরিবার ও এলাকার লোকজন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার তওফিককে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন তার রক্তে নিকোটিনের পরিমাণ অত্যাধিক। ফলে ফুসফুসের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। গরিব বাবা এমন সিদ্ধান্তে নিরুপায় হয়ে পড়লে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ঢাকায় নেওয়ার ব্যবস্থা চলছে। তওফিক একজন কর্মজীবী শিশু। নিজে উপার্জন করে পড়াশোনা চালিয়ে তার বাবাকেও সংসারে সাহায্য করে। এলাকাবাসী এক কথায় তাকে ভালো ছেলে হিসেবে অখ্যায়িত করে। এবার জেএসি পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। তওফিকের এমন অসুস্থতাকে পাড়ার কেউ মেনে নিতে পারছে না।

সারা দেশে পথশিশু, স্কুলপড়ুয়া শিশু, শ্রমজীবী শিশুদের দেহে মাত্রারিক্ত নিকোটিন পাওয়া গেছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। খোদ ঢাকা রাজধানীতেই প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পরিলক্ষিত হয়েছে। সংবাদটি খুবই আশঙ্কার, তবে পরোক্ষ ধূমপানই এর মূল কারণ। এই শিশুরা যদি নিকোটিনে আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে তাদের ভবিষ্যৎ কী? তবে কী কারণে শিশুদের শরীরে নিকোটিনের প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে তা প্রথমে অনুসন্ধান করা দরকার। আপাতত মনে করা হয় পারিবারিক ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলেই এই শিশুদের দেহে জীবননাশী নিকোটিন নিবাস নিয়েছে।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা পরমাণু চিকিৎসাকেন্দ্রের শিশু স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিদ বিশারদ ড. আজিয়া ফৌরদোস খান বলেন, ‘সচরাচর দেখা যায় গ্রামের মানুষরা সন্তানদের সম্মুখে, ঘরে-বাইরে ধূমপান ও তামাক সেবন করে থাকেন। এতে সহজেই ধারণা নেওয়া যায় ধূমপানের পরোক্ষ প্রভাবে গ্রামের শিশুদের দেহে নিকোটিনের মাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শহরের মানুষও যে এতটা অসচেতন, ভাবতে বিস্মিত হতে হয়। পিতা-মাতার অসচেতনার কারণে নিকোটিন আক্রান্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। ফলে তাদের ফুসফুস শিশুকাল থেকেই ভয়ানক ক্ষতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। প্রজন্মকে নিকোটিনের বিষ থেকে মুক্ত থাকতে এখনই এর বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপক প্রচারণা চালানো উচিত। এজন্য পথে-প্রান্তরে স্কুলে ক্যাম্পেইন, রেডিও, টিভি, পত্রিকা, অনলাইনসহ সব সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করা জরুরি।’

সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে সহায়তা করা। সমাজের সব ক্ষেত্রে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি না করলে আমাদের আগামী দিনগুলো হবে দুর্ভাবনার। মায়েরা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য নির্ভর করে হরলিক্স এবং কমপ্ল্যানের ওপর। জিপিএ ৫-প্রাপ্ত হলেই শিশুর মেধাবী হওয়ার গৌরবের চিহ্ন। সামর্থ্যবানরা বুঝে হোক না বুঝে হোক শিশুকে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তেমন আগ্রহী নন। শিশুরা কমবেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। একইভাবে পরিবারে-সমাজে পীড়নের শিকার সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় লক্ষ করা যায় আমাদের শিশুরা মায়া-মমতা, আদর-স্নেহ, নিরাপত্তা, পুষ্টিকর খাবার, বিনোদন সুশিক্ষা থেকে অনেকখানি বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠছে।

মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে মাদকাসক্তির জন্য একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গত আট বছরে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৭৭ থেকে ১০০ গুণ। নেশা হিসেবে মাদকের প্রতি আসক্তি কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে ক্রমে ক্রমে শুরু হয় সিগারেট বা ধূমপান থেকে সমবয়সীদের বা কখনো কখনো অসমবয়সিদের পারস্পরিক সাহচার্যে। পথশিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য পুষ্টিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ওদের নেই নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা। খোলা আকাশ, পার্ক, ফুটপাত, রেলস্টেশন, ফেরিঘাট-লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা বাসস্টেশনেই তাদের থাকার জায়গা। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মাদকে আসক্ত।

বাংলাদেশে প্রায় সব সমাজের বিশেষ করে শহুরে সমাজের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীর একটি বিরাট অংশ আজ মাদকের ভয়াবহ গ্রাসের শিকার। সম্প্রতি সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দেশে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি দাবানলের মতো এবং আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্লোবাল অ্যাকাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন ৩ কোটি ৭৮ লাখ অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৩ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে ৪ কোটি ৮ লাখ মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে নারীরা আক্রান্ত হচ্ছে অনেক বেশি। পরিসংখ্যানে বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অন্যতম। তামাক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে। দেশে ধোঁয়াহীন তামাক গুল, জর্দা সাদাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে নারী ২৪ দশমিক ০২ শতাংশ এবং পুরুষ ১৬ দশমিক ০২ শতাংশ। বাংলাদেশে ধূমপান ও ধোঁয়াহীন তামাক সেবনের ফলে ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ, ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, হাঁপানি ইত্যাদি রোগে ১২ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়। ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হয়। প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

সারা পৃথিবীতে মৃত্যুর পাঁচটি শীর্ষস্থানীয় কারণের মধ্যে দুটিই ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্র-সংক্রান্ত জটিলতা। আর তামাক ব্যবহার ও পরোক্ষ ধূমপান ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের প্রধানতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় এমন তিনটি দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থটি হচ্ছে তামাক ও সিগারেট। সিগারেট বা তামাক থেকে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে ২৫টি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অল্প বয়সের শিশুদের জীবনের শুরুতেই এ ভয়াবহতা থেকে রক্ষায় প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতন হওয়া। কারণ তাদের অসচেতনতার কারণে পরোক্ষভাবে নিকোটিন নিচ্ছে নিষ্পাপ সন্তানরা।