“আজ থেকে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যি তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর”- কবি কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষকের মর্যাদা কবিতাটি কমবেশি আমাদের অনেকের পঠিত। শিক্ষকের মর্যাদা দেয়ার প্রতি একজন পিতার শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। মানুষের সাথে মানুষের যে সর্ম্পক, যোগাযোগ তা রক্ষা করার বিস্তৃতক্ষেত্র তৈরি করতে হয় জীবনের শুরুতেই। শিক্ষক আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়জন। পিতা-মাতার পরই শিক্ষকের অবস্থান। শৈশব হতে শুরু করে পুরো মানবজীবনকে সুশৃঙ্খল ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পরিবারের পর শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেন।। বাদশাহ আলমগীর শিক্ষকের প্রতি সন্তানের একটু অবহেলা (কুমার কেন নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুঁয়ে দেয়নি) দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এবং সব মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাদের মধ্য থেকেই শিক্ষকগণ তৈরি করবেন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদ, দক্ষ প্রশাসক, উদ্যোক্তা, খেলোয়াড়, সমাজকর্মী, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। শিক্ষক, শিক্ষার্থী সর্ম্পক হলো মিষ্টি মধুর ও পবিত্র। যা কিনা শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালোবাস এবং কোমল ঘনিষ্ঠতার উষ্ণতায় মিশেলে এক সুসর্ম্পক। আর পিতা-মাতা ও পরিবারকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। শিশুমন হচ্ছে কাদা মাটির মতো নরম, তাকে যেভাবে ইচ্ছে গড়ে তোলা সম্ভব। যার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক সুষ্ঠ মানসিক পরিচর্যা। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়াম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মোঃ লোকমান হোসেন মনে করেন, “পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ। পিতামাতার নিকট শিশুর শিক্ষাদীক্ষা শুরু। মূলতঃ শিশুরা পিতামাতার কাছেই নৈতিকতা, আর্দশ, দেশপ্রেম, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান জানাতে শিখে। তাই পিতামাতাই শিশুর প্রথম আর্দশ শিক্ষক কিংবা পিতামাতকেই শিশুরা তাদের প্রথম আর্দশগুরু হিসেবে মানতে শুরু করে। আর সে কারণে শিশুর বেড়ে ওঠায় পিতামাতা এবং পারিবারিক ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শিশুকে বুঝতে দিতে হবে নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলেন এবং নিজেকে সেই শিক্ষার্থীর আলোকিত জীবনের গর্বিত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন এমনকি ব্যক্তি জীবনেও তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতায় শিক্ষককে স্মরণ করেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলো সাফল্য-ব্যর্থতা, গ্লানি কিংবা গবের্র সমান অংশীদারিত্বের সম্পর্ক। শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা জীবনকে জানতে, চিনতে ও বুঝতে শেখে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে যায় জ্ঞানের পথে, আলোর পথে বিচার বুদ্ধি দিয়ে কাজ করার জন্য। শিক্ষক যে দর্শন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন তার ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের ব্রত ঠিক করে।”
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক্স অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ এবং ভারকি ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল টিসার্চ স্ট্যাটাস ইনডেক্স-২০১৮’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে গড়ে মাত্র ৩৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করে। অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করে না। এই ভয়াবহ অবস্থা দূরীকরণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক জাগরণের পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের নিজ দায়িত্বের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান, শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলিতে গড়ে তোলা, কর্মক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মনোভাব পোষণ না করা, সততা বজায় রাখাসহ বিভিন্ন ইতিবাচক কার্যক্রমের দ্বারা নিজেদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং রেষারেষিরও অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষকদের পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্য দ্বন্দ্বও তাঁদের প্রতি শিক্ষার্থীদের বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।
শিক্ষার্থীর পিতামাতা বা পরিবারের সদস্যরা আজকাল ভুলে যান প্রারম্ভে সন্তান মানুষ হতে হবে। আর একজন সৎমানুষ হতে হলে মানবিক গুণাবলির প্রথম নৈতিকতা হলো শিক্ষাঙ্গণের অভিভাবক শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও সন্মানবোধ লালন করা। অনেক অভিভাবক মনে করেন অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারে অধ্যায়ন করাচ্ছি, শিক্ষক তো সময়ের কর্মচারী। তথাগত এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে অভিভাবকদের বের হয়ে আসতে হবে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় ছয় শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। এক শিক্ষার্থীর মা মামলা করায় ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার জামিন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিলেই তাকে কারাগারে যেতে হবে, এ কেমন কথা! একজন শিক্ষকের যে তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের শাসন করার অধিকার আছে (চুল কেটে দিয়েছেন) যেজন্য তার জামিন না মঞ্জুর করা হয়। শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের পারিবারিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্ধও ছিল না, কিন্তু শিক্ষককে জেলে যেতে হলো। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কের অবনতির ফলাফল আর প্রশ্নের আঙুল ওঠে শিক্ষকসমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি। কিন্তু কোথাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানবিক সম্পর্কের বিষয়টির কথা উঠে আসেনি। এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে, যদি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সর্ম্পকের উন্নতি না হয়। শিক্ষক হবেন ছাত্রের গর্ব আর ছাত্র হবে শিক্ষকের অহংকার। শিক্ষার্থীদেরকে জীবনধর্মী ও বাস্তবমুখী দক্ষতা শেখানোর ওপর জোর দেয়া উচিত। শিক্ষার আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র এবং শিক্ষকের সাথে বৈরী সর্স্পকের ফলশ্রুতিতে ঘটে গেছে বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান জামাল নাসের বলেন, “শিক্ষাঙ্গণের প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত হন শিক্ষকরা। তারাই শিক্ষাঙ্গণের মূল ধারক। তাদের আলোকেই উদ্ভাসিত হন শিক্ষার্থীরা। একজন শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পিতা। জন্মদাতা পিতা পরম আনন্দে হাত ধরে তার সন্তানকে হাঁটতে চলতে শেখান। একইভাবে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক শিক্ষার্থীকে পরম মমতায়, মৃদু শাসনে পথ চিনিয়ে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করান।”
পূর্বে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণের জন্য তারা নিজের সকল ভোগ-বিলাস ত্যাগ করতেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে তারা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন। শ্রেণিকক্ষে এমনভাবে পাঠদান করতেন যার ফলে বাড়িতে এসে শিক্ষার্থীকে খুব একটা পাঠ রপ্ত করতে হতো না। প্রয়োজনে যে কোন সময়ে শিক্ষকের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া যেতো। ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরিতে শিক্ষকরা অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করিয়ে দিতেন। এমনকি কোন কোন শিক্ষক বিনা পারিশ্রমিকে বাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন। কবিশুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “শিক্ষার বিষয়টি বাজার অর্থনীতির বাহিরে নিতে হবে। শিক্ষার বাজারের বিদ্যাবস্তু পণ্যায়িত হতে পারে না।” পারমিতা ফাইহা বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। জানা যায়, স্কুলের এক শিক্ষক তাকে বাসায় প্রাইভেট পড়তে বলেছিলেন। পারমিতা রাজি না হওয়ায় উচ্চতর গণিতে প্রথম দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় তাকে অকৃতকার্য করা হয়। এতে স্কুলের অধ্যক্ষ পারমিতার অভিভাবকদের সাক্ষাৎ করতে বলেন। বিষয়টি পারমিতাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে, প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলে। অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে। পড়াশোনায় বরাবর ভালো ফল করা শিক্ষার্থীটি শিক্ষকের এমন ব্যবহার সহ্য করতে পারেনি। তাই নিজস্ব বাসভবনের ১২তলার ছাদ থেকে লফিয়ে পড়ে আত্মহনন করে। ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ইট্যাব) এর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ, পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল, বদলে যাচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও রুচিবোধ, হিংসা-বিদ্বেষ প্রকাশের ধরনও পরিবর্তিত হচ্ছে। পাশাপাশি আধুনিকতার অজুহাতে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শিক্ষার কৌশল পদ্ধতি বদলে যায়। প্রাণহীন, স্পর্শহীন হয়ে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থাটি। অধিকন্তু প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং, নোট বিতরণ ইত্যাদি কার্যক্রম দ্বারা শিক্ষার ব্যবস্থাকে অর্থ উপার্জনের এক উত্তম পন্থা হিসেবে পরিচিত করে শিক্ষক সমাজের একাংশ। ফলে বিশ্বে প্রতি বছর অর্ধ মিলিয়ন শিক্ষক তাদের চাকরির ৫ বছরের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেন। তারা পেশার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না। এখানে মুটিভেশনের অভাব রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছর বছর শুধু শ্রেণি কার্যক্রম, খাতা মুল্যায়ণ, পরীক্ষা নেয়া ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকলে পেশাগত উন্নয়ন যেমন কম হয়, তেমনি শিক্ষকদের মধ্যে একই ধরণের কর্মবিরক্তি এসে যায়।
শিক্ষক একটি অত্যন্ত মহান শব্দ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ন্যায়, নিষ্ঠা, আদর্শ ও আত্মত্যাগ। একজন আদর্শবান শিক্ষক একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে তার শিক্ষাদানের মাধ্যমে বদলে দিতে পারে। পড়াশোনার পাশাপাশি নৈতিকতা, মানবিকতা, মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। পারিবারিক শিক্ষা আমাদের হাতেখড়ি শেখালেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকরাই মূলত আমাদের মানুষ হিসেব গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে এই মহান পেশায় এসেছেন। শিক্ষকদের সাজানো বাগানে আমাদের সন্তানরা সভ্যতার মানবিক গুণাবলীতে প্রস্ফূটিত হবে। আমরা পাব একটি সুন্দর, শান্তিময় পৃথিবী। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের বেড়ে ওঠা ও শিক্ষার প্রথম পাঠ পরিবারেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। শৈশবের শিক্ষাইতো সুদৃঢ়ভাবে মন-মেধায় গেঁথে যায়।