জলবায়ু অভিযোজনে নারীর প্রজনন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রবল বেগ এবং দীর্ঘস্থায়ী ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে উপকূলীয় খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায়। আইলার আঘাতে নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। আইলার আঘাতের পরপরই শুরু হয় বর্ষাকাল। নদীগুলোর পানি বৃদ্ধির কারণে সময়মতো বাঁধ মেরামত সম্ভব হয় না। গৃহহীন জনগণ আশ্রয় নেয় নদীর বেড়িবাঁধের ওপর। সরকার এসব এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করলেও পানীয় জল এবং চিকিৎসাসেবার অপর্যাপ্ততা রয়েই যায়। এর প্রভাব পড়ে নারী ও শিশুদের ওপর। খাবার পানির অভাব তো আছেই সেই সঙ্গে রোগবালাই এবং চিকিৎসার অভাবে দুই গ্রাম খুঁজেও ডাক্তারের দেখা মিলে না। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের নারীরা পরিবারের খাদ্য, শাকসবজি, পানীয় জল, সেবাশুশ্রুষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

বাংলাদেশের মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৮৭ শতাংশই নারী এবং তারা পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, প্রাণিসম্পদ, বৃক্ষসম্পদ ও ফসল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এসব খাত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নারীদের ওপর পানীয় জল সংগ্রহ ও গৃহস্থালি কাজের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের হার কমছে। শুধু পানি সংগ্রহের জন্য পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নারীদের মৃত শিশু জন্মদানের হার দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া পানি সংগ্রহের জন্য চিংড়িঘেরের (যা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান মানবসৃষ্ট কারণ) বেড়িবাঁধের ওপর দীর্ঘ নির্জন পথ পাড়ি দেওয়ার সময় নারী ও কিশোরীরা প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। দুর্যোগের হার ও ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায়ও ঘাটতি দেখা দেয়। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে পায়খানা ও টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় নারীরা চরম সংকটে পড়েন। অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের অনিরাপদ পরিবেশ ও সীমিত জরুরি সেবার কারণে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে পড়ে। দুর্যোগের পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নারী, কিশোরী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। দুর্যোগের পর স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পরিবারের আয়ক্ষম পুরুষ সদস্য কাজের খোঁজে সাময়িকভাবে অভিবাসিত হন। এ সময় সন্তান ও পরিবার নিয়ে নারীরা অমানবিক জীবনাযাপনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক নারী মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।

সাতক্ষীরা জেলায় সুন্দরবন উপকূলে লোনাপানির প্রভাব ও নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকিবিষয়ক সেমিনারে ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততা প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে আবারও সেটি ব্যবহার করে এবং লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জলবায়ু-সংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ু-সংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত হলে ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের পুরো জরায়ু কেটে ফেলার পর অনেকের স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করছেন। গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা সহযোগী সুরাইয়া ইয়াসমিন মায়া জানান, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২৭ বর্ষিয়ান জরিনা খাতুনের একাধিক গর্ভপাত হয়েছে। পরিবারের অভাব। পুষ্টির অভাবে তিনি এখন নিয়মিতই অসুস্থ থাকেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জরায়ু সংক্রমণ। এমন জড়িনা খাতুন সংখ্যাতীত আর কিশোরীদের মধ্যে স্যানিটারি প্যাডের প্রচলন সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হলেও সেটি এখন উল্লেখযোগ্য নয়। এ ছাড়া চল্লিশের ঊর্ধ্বে নারীরা স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার না করায় এসব নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক বিপন্ন পরিস্থিতিতে রয়েছে।’

সম্প্রতি বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বছরের পর বছর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর, আম্পান, ইয়াসে বিধ্বস্ত হয়েছে উপকূল। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। দুর্যোগে পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে নারীর ওপর। অথচ উপেক্ষিত থাকে তাদের স্বাস্থ্যসেবা। চলতি শতাব্দীতে বন্যার এই ঝুঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বন্যায় উপকূলীয় এলাকায় বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় দশ হাজার কোটি টাকা সম্পদ। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ চলতি শতাব্দীতে দ্বিগুণ হতে পারে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে উপকূলের চার হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে।

ইউএনএফপিএর (জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল) প্রতিবেদন অনুসারে, গর্ভবতী নারী এবং কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। দুর্যোগের সময় পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়ে নিহত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ছিলেন নারী। এবং ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় আক্রান্তদের ৭৩ শতাংশই ছিলেন নারী। ২০২০-২১ সালে খুলনার দাকোপ উপজেলার ১৩ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ৩৪৫ জন গর্ভবতী নারী নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত নোনাপানি গ্রহণের ফলে নারীদের উচ্চ রক্তচাপ, জরায়ুর প্রদাহ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশুও জন্ম দেওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে। এ ছাড়া নারীরা দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষিকাজ, গবাদি পশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়েছে। লবণাক্ত পানিতে চিংড়ির পোনা ধরা, মাছের ঘেরে কাজ করা, লবণাক্ত পানি পানসহ দৈনন্দিন কাজে নারীকে সবচেয়ে বেশি সময় থাকতে হয়। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির দৈনিক পাঁচ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় জনগোষ্ঠীকে দৈনিক ১৬ গ্রামের অধিক লবণ খেতে হচ্ছে, যা দেশের অন্য এলাকার জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক গুণ বেশি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীদের গর্ভপাতের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিই দায়ী। সরকার উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন বা সহনশীলতার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয় বছরমেয়াদি (জানুয়ারি-২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মহিলা অধিদপ্তর। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৫টি উপজেলার (কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, আশাশুনিও শ্যামনগর) ৩৯টি ইউনিয়নের সাত লাখ মানুষ এ সুবিধা পাবে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়েত বলেন, কালের পরিক্রমায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের গ্রামীণ নারীরা পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার নানা উপায় অনুসন্ধান করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীদের বিপন্নতার মাত্রা বেশি হওয়া সত্ত্বেও অভিযোজনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট ও ফলপ্রসূ হিসেবে প্রমাণিত। বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়। উপকূল অঞ্চলে একটি পাইলট স্ট্যাডি করতে লবণাক্ততা ও নারীর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে। আমাদের চিকিৎসকদেরও গবেষণা কাজে আরো বেশি যুক্ত হওয়ার দরকার।

জার্মান ওয়াচ গ্লোবালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২০) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের একটি। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে এর ১৭ শতাংশ জমি এবং খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হারাতে চলেছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব পড়েছে। যার ফলে অভাব বেড়েছে, বেড়েছে অপুষ্টি। কৃষক পরিবারে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বিভিন্ন পরিবারে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বাল্যবিবাহ। এসব সীমাবদ্ধতাই হতে পারে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়েেন অন্যতম বাধা। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের অকাল গর্ভপাত, প্রজননতন্ত্রের সমস্যা, ঋতুচক্রজনিত সমস্যাসহ জরায়ু কেটে ফেলার মতো যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এটি কেবল উপকূলের নারীদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কারণ, এ নারীরাই উপকূলের কৃষি ও মৎস্য খাতে গুরুত্বর্পুণ অবদান রাখছেন।

বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বোচ্চ জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলোর একটি। ভৌগোলিক অবস্থান, বর্ধিত জনসংখ্যা ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে এমনিতেই দেশটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তন এ সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তুলেছে। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা এবং অতিরিক্ত গরম ও শীতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকহারে। এসব দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে বিপদাপন্ন নারী ও শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে।