সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএনডিপির সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ আয়োজিত ‘গ্রাম আদালতের প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় কর্মশালায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাম আদালতে গ্রামীণ মানুষের দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এখন অল্প খরচে, স্বল্প সময়ে এবং সহজে মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ থাকায় দিনে দিনে বিরোধ-নিষ্পত্তির হার ছাড়িয়ে গেছে অতীতের রেকর্ড। প্রায় শতভাগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দেশের উচ্চ আদালতে মামলাজট নিরসনে পথ দেখাচ্ছে। দেশের মানুষের কাছে গ্রাম আদালত আস্থা অর্জন করেছে বলেই প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে শেষে এখন তৃতীয় পর্যায়ে শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।’
পল্লী এলাকার নারী, দারিদ্র্য ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যাতে তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিকার স্থানীয় পর্যায়ে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের ১৪ জেলার ৫৭টি উপজেলায় ৩৫১টি ইউনিয়নে (২০০-২১৫) ‘অ্যাক্টিভেশন ভিলেজ কোর্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রথম পর্যায় সমাপ্তির পর উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে দেশের ২৭ জেলার ১২৮টি উপজেলার ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নে বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ করছে।
সম্প্রতি ৩ পার্বত্য জেলার ২৬ উপজেলার ১২১টি ইউনিয়ন পরিষদকে এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য প্রকল্প এলাকার অন্তর্ভুক্ত ২৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলার ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়ন প্রকল্পের চলমান কার্যক্রমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী অফিসার, উপপরিচালক, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রাম আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ প্রসঙ্গে ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, ‘গ্রাম আদালতে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির ফলে তথ্যানুযায়ী প্রায় ১২ হাজার মামলা জেলা জজ কোর্ট থেকে গ্রাম আদালত অর্পণ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ জমি-জমাসহ ছোট বিষয়েও মামলা করে থাকেন। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অনেকে অর্থ ও সময় নষ্ট করে দীর্ঘ সময় ধরে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। গ্রাম আদালতে আড়াই লাখের বেশি মামলা হয়েছিল। যার মধ্যে দুই লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। গ্রাম আদালত কার্যকর ও শক্তি বৃদ্ধির ফলে মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
গ্রাম আদালত : একজন চেয়ারম্যান এবং উভয় পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুজন করে মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুজন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন, তবে কারণবশত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হন কিংবা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় সে ক্ষেত্রে মনোনীত সদস্য ব্যতীত উক্ত ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোনো সদস্য গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন। যে ইউনিয়নে মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হয় বা মামলার কারণ উদ্ভব হয়, সেই ইউনিয়নে গ্রাম আদালত গঠিত হবে, তবে পক্ষগণ ইচ্ছা করলে নিজ ইউনিয়ন হতে প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারবেন।
আপিল আবেদন : এ আদালত কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বা সম্পত্তি বা দখল প্রত্যর্পণের আদেশ দিলে উক্ত আদেশ গ্রাম আদালতের জন্য নির্ধারিত ফরমে ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে আদেশ প্রদান করবেন এবং তা রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ক্ষতিপূরণের অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদান করতে ব্যর্থ হলে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান (চেয়ারম্যান ভিন্ন ব্যক্তি হলে) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট বিষয়টি প্রেরণ করবেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ এর বিধান অনুসারে বকেয়া করের ন্যায় ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করবেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে প্রদান করবেন। গ্রাম আদালত কোনো মামলায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বা পাঁচজনের মধ্যে চারজন একমত হলে সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। আর তিনজন একমত হয়ে দুজন ভিন্নমত পোষণ করে সিদ্ধান্ত দিলে সে সিদ্ধান্ত ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে যে কোনো পক্ষ উক্ত সিদ্ধান্ত বাতিল, পরিবর্তন বা পুনর্বিচারের জন্য ফৌজদারি বিষয়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বা দেওয়ানি বিষয়ে সহকারী জজ আদালতে আপিল করতে পারবেন।
অবমাননার শাস্তি : গ্রাম আদালত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ করার আদেশ দিতে পারবে। এ আদালত কাউকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবে না। গ্রাম আদালতকে অবমাননা করলে, আদালতের প্রশ্নের জবাব না দিলে, কোনো দলিল দাখিল না করলে, আদালতের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে, সত্য না বললে আদালত ওই ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন। তবে কাউকে জেলে পাঠাতে পারবেন না।
সাক্ষী তলবের সক্ষমতা : গ্রাম আদালত গঠন হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। উক্ত সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে, গ্রাম আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করবে। অন্যথায় মেয়াদ শেষে গ্রাম আদালত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেঙে যাবে। আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য বা কোনো দলিল দাখিলের জন্য গ্রাম আদালত কোনো ব্যক্তিকে সমন দিতে পারবেন। সমন পেয়েও কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের আদেশ অমান্য করলে আদালত তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে অনধিক ১ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে।
আইনজীবী নিয়োগ : গ্রাম আদালতের বিচার কার্যক্রমের কোনো পর্যায়ে কোনো আইনজীবী উপস্থিত থাকতে বা কোনো পক্ষ সমর্থন করে কোনো বক্তব্য রাখতে পারবেন না। জনস্বার্থে বা ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন মনে করলে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গ্রাম আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলা প্রত্যাহার করে ফৌজদারি আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করতে পারেন। তা ছাড়া গ্রাম আদালত যদি মনে করেন যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আসামির জরিমানা নয়, শাস্তি হওয়া প্রয়োজন তবে মামলাটি ফৌজদারি আদালতে প্রেরণ করতে পারবেন। এছাড়াও মামলার কোনো পক্ষ যদি চান ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৮ ধারা মোতাবেক কোনো ফৌজদারি মামলা বা দেওয়ানি কার্যবিধির ২৪ ধারা মোতাবেক কোনো দেওয়ানি মামলা হস্তান্তর বা নথি তলবের জন্য যথাযথ ফৌজদারি বা দেওয়ানি আদালতে আবেদন করতে পারবেন।
ফৌজদারি অপরাধের ধারা : দণ্ডবিধি ১৪১,১৪৩, ১৪৭, ১৬০, ৩২৩, ৩৩৪, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫২, ৩৫৮, ৪২৬, ৪৪৭, ৫০৪, ৫০৬, ৫০৮, ৫০৯ এবং ৫১০ ধারা। শুধু গবাদিপশু (যার মূল্য অনধিক ৭৫ হাজার টাকা) চুরির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৯, ৩৮০ এবং ৩৮১ ধারা। গবাদিপশু ব্যতীত অন্য চুরির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি ৩৭৯, ৩৮০,এবং ৩৮১ ধারা চোরাই মালের মূল্য যখন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। দণ্ডবিধি ৪০৩, ৪০৬, ৪১৭, ৪২০, ৪২৭, ৪২৮ এবং ৪২৯ ধারা ক্ষতির পরিমাণ যখন ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া গবাদিপশু অনধিকার প্রবেশ আইন-১৮৭১ এর ২৪, ২৬ এবং ২৭ ধারার অপরাধের বিচার গ্রাম আদালতে অনুষ্ঠিত হবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ বা অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য বা অপরাধ সংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পত্তির মূল্য অনধিক ৭৫ হাজার টাকা।
বিধিমালা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হয় গ্রাম আদালতে। গ্রাম আদালত গঠিত হওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে সভা আহ্বান করা হয়। সভায় আবেদনকারী ও প্রতিবাদকারী উভয় পক্ষের মধ্যে আপসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয় আদালত। এতে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করে তা নিষ্পত্তি করা হয়। অল্প খরচে, স্বল্প সময়ে এবং সহজে মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ থাকায় দিনে দিনে নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এ আদালতে। দারিদ্র্য নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন- প্রতিবন্ধী, দলিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী যারা আইন-আদালতে সংক্রান্ত ‘ভয়ের কারণে’ বিচারিক সেবা গ্রহণে আগ্রহী নন, তারাও গ্রাম আদালতে এসে সুফল পাচ্ছেন। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ২নং (উত্তর) দুর্গাপুর ইউনিয়নের একাধিক বাদী-বিবাদীর সঙ্গে আলাপকালে জানান, পাঁচ বছর আগেও পরিবারের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলে স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে বিচার নিয়ে গেলে তারা একপেশে বিচার করতেন। যেদিকে লোক বেশি সেদিকে সমর্থন জানাতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইস্যু টেনে স্থানীয় সালিস ব্যবস্থা কৌশলে ভন্ডুল করা হতো। কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মামলার দিকে ঝুঁকে পড়েতেন এসব অসহায় মানুষ। মামলা করে বছরের পর বছর আদালতে ঘুরে ঘুরে আর্থিক, মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
গ্রামাঞ্চলে স্বীকৃত ‘ভিলেজ পরিটিক্স’ শব্দের ধারক ও বাহক কিছু মন্দ মানুষের কবলে পড়ে অন্যায়-অবিচারের শিকার হচ্ছেন সরল শ্রেণিভুক্ত মানুষ পাশাপাশি দুর্নীতির যাতাকলে পিষ্ঠ গ্রাম্য সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর যাতে কোনো মতলববাজ গোষ্ঠী অন্যায়-অবিচার করতে না পারে এজন্য গ্রাম্য এই মন্দ দলভুক্ত মানুষগুলোকে শায়েস্তা করে কীভাবে গ্রামের বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য করা যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে এবং গ্রাম্য সালিসে অবৈধ ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে সমাজে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং সরকারি সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন, গ্রাম আদালত তার একটি। এর মাধ্যমে গ্রামের লোকজন তার ইউনিয়ন পরিষদে নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ পাচ্ছেন।