নোনাপানিতে দুঃসহ নারী-শিশুর জীবন

বর্তমান বাস্তবতায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সহনশীলতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন উপকূল অঞ্চলের নারী ও শিশুরা। এক কলসি মিঠাপানি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় জীবন বিপন্ন করে হলেও খেয়াল রাখতে হয়, যেন একফোঁটা নোনাপানি কলসিতে মিশে না যায়।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা হয় প্রতাপনগর গ্রামের অশতিপর বৃদ্ধা মোহর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আট মাস পর সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর চরিত্র পাল্টেছে। জোয়ারে এখন পানি আরো তীব্র বেগে ছুটে আসে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বেড়েছে আর সেই সঙ্গে পাল্লা নিয়ে বাড়ছে লবণাক্ততা।’ ঝাউডা-া গ্রামের বাসিন্দা সাবিত্রী রানী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন জোয়ারের সময় আমার ঘরের মধ্যে পানি উঠে যায়। ভাটায় নেমে যায়- এভাবে জীবন চলছে।’

সাতক্ষীরার কটি ইউনিয়নের পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শত শত মানুষ জলাবন্ধকতার কারণে সুপেয় পানি, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্পত শৌচাগারের অভাবে তারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর মুকুন্দপুর গ্রামের জিন্নাত জাহান ছয় কিলোমিটার দূরের জেলেখানি এলাকা থেকে পানির নৌকা নিয়ে ফিরলেন। নৌকা ভাড়াই ২০০ টাকা। ১০টি পরিবারের ড্রাম নিয়ে গিয়েছিলেন। ড্রামপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা আর প্রতি ড্রাম পানির জন্য আরো ১৫ টাকা। সব মিলিয়ে ২০ লিটার পানি কিনতে হয়েছে ৩৫ টাকায়। খলিশাবুনিয়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ বেহুলাবিবি। চলতে-ফিরতে কষ্ট হয় তার ভীষণ। তবু রেশনিং পানি আনতে যায়। ধুমঘাট গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন ঘরের বেলিবালা বলেন, ‘পুকুরের পানিতে এত লবণ যে পানি পান করার অল্পসময়ের মধ্যে ডায়রিয়ার দেখা দেয়। আমার ১৭টি গরু সর্বক্ষণ বেঁধে রাখতে হয় দূষিত পানি যেন পান করতে না পারে; নিরীহ গবাদি পশুগুলোর পানির জন্য ছটফট করা দেখে কষ্ট হয়, তবু পানির অভাবে পানি দিতে পারছি না।’

সাতক্ষীরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত বৈদ্য বলেন, ‘বিশুদ্ধ পানির হাহাকার সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাগুনি উপজেলার বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে। লবণাক্ততর কারণে এ অঞ্চলে খাবার পানির আকাল গত ২০ বছরের। তবে ২০০৯ সালে আইলার পর পরিস্থিতি আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ইউনিয়নে গ্রামের সংখ্যা ১৯টি। তার মধ্যে সফলভাবে নলকূপ বসানো হয়েছিল ৪টি গ্রামে। বাকি ১১টি গ্রামে নলকূপে খাওয়ার যোগ্য পানি ওঠেনি। তারা সবাই পুকুরের পানি পান করত। পুরো ইউনিয়নে পুকুর ছিল ৪২টি। আইলার পর ৪০টি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে দু-একটি সচল নলকূপ এবং সরকারি-বেসরকারি রেশনিংয়ের পানিতেই বেঁচে আছে এই ইউনিয়নের মানুষ। পরিবারের পুরুষরা কাজে ব্যস্ত থাকায় পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে নারী ও শিশুদের। বর্তমানে সুপ্রেয় পানির জন্য দুটি পাওয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। এলাকায় বৃষ্টির সময় ৭ থেকে ৮ মাস জলাবন্ধতা থাকে এবং লবণাক্ত থাকায় খাবার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই।’

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান জানান, ‘বল্লী, ঝাউড-াসহ কয়েকটি এলাকায় পানির নেওয়ার বা পাওয়ার ডিপটিউবওয়েল বসানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। সমস্যা মোকাবিলায় সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কাজ করছে জেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ। সহযোগী হিসেবে কাজ করছে স্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন। এ অঞ্চলকে আমরা বেশি লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছি। আইলা, ইয়াস, আম্পানের পর শুকনো মৌসুমে পুকুরের পানি অতিমাত্রায় লবণাক্ত হওয়ায় পান করতে হয়েছে ধরে রাখা বৃষ্টির পানি। আর সেই ধরে রাখা পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় সংকট তীব্রতর হয়েছে। তবে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা আগের চেয়ে যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। খোলা স্থানে মূলত্যাগের হারও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।’ এ বিষয়ে উত্তরণ ওয়াই-ওয়াশ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী হাসিনা পারভীন জানান, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ৭৯ শতাংশ নলকূপে মাত্রারিক্ত আর্সেনিক রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ছাড়া পদ্মা প্রবাহ থেকে এলাকার বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যাপকভাবে নোনাপানির চিংড়ি চাষের কারণে এলাকায় লবণ্যক্ততার তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ আগে সংরক্ষিত পুকুরের পানি পান করত, এসব পুকুরের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এসব অঞ্চলে খাবার পানি সংগ্রহ করা বিশেষ করে মহিলাদের বড় ধরনের কঠিন কাজ। এক কলস খাবার পানি সংগ্রহের জন্য ২ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়, দাঁড়াতে হয় দীর্ঘলাইনে। দিনের একটা বড় অংশের শ্রমঘণ্টা ব্যয় হয় এ কাজে। তার পরও যে পানি সংগ্রহ বা কেনা হয় সেটা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। এদিকে খাবার পানির সংকটের সুযোগ নিয়ে অসংখ্য ব্যবসায়ী খাবার পানি বিক্রির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এসব ব্যবসায়ীর ব্যবহৃত প্রযুুক্তি অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশসম্মত নয়। তা ছাড়া দরিদ্র মানুষের পক্ষে উচ্চমূল্যের এসব পানি কিনে খাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার ফলে তারা অনিরাপদ পানি পান করে যেকোনো সময় পেটের পীড়া, আমাশয়, ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ফাহাদ হোসেন অভিমত বেতনা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং এলাকায় শত শত মাছের ঘেরের কারণে পানি সঠিকপথে নিষ্কাশন হতে না পারায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ সময় তারা নিরাপদ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পাশাপাশি এ সমস্যা উত্তরণে দীর্ঘদিন ধরে অত্র এলাকায় হতদরিদ্র ও সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে তাদের সচেতন করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। তাদের সংগঠন সবুজ বাংলা।

এনভায়রনমেন্টাল লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় পানি অবকাঠামোগুলোর কার্যকারিতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩-তে জনগণের অধিকার বঞ্চনার বিষয়ে জবাবদিহির কোনো সুযোগ নেই। মানুষের কোনো মতামতও প্রতিফলিত হয়নি। এ আইন পাস করার আগে জনগণের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু বন্যাদুর্গত উপকূলের মানুষ, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তো ইন্টারনেট অ্যাকসেস করতে পারেনি, তাই তারা তাদের মতামত দিতে পারেনি।’ বেলার আরেক আইনজীবী ইকবাল করিম বলেন, ‘পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পানি পাওয়া একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে জাতীয় পানিনীতি-১৯৯৯-এ ২০১২ সালের খসড়া নীতিমালায় স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩-তে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। এ কারণে প্রণীত এ আইনে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত পানি পাওয়াকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় আইনটি জনস্বার্থে রক্ষায় দারুণভাবে ব্যর্থ হবে।’

ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউর (আইআরভি) নির্বাহী পরিচালক মেরিনা যূথী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের অন্যতম একটি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা কয়রা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখানকার নারীরা চর্মরোগ, উচ্চরক্তচাপ, বাতের ব্যথা, গর্ভকালীন সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হন। কিন্তু স্বল্প আয় ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দূরে থাকায় তারা খুব সহজে যেতে পারেন না। স্বাস্থ্যকর্মীরাও কখনো তাদের গ্রামে তেমন যায় না। কিন্তু এসডিজি ৬ নম্বর গোল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত নারীদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সংযুক্ত করতে হবে।’

উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত জলবায়ু অভিযোগজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) বাস্তবায়নাধীন ৮৩টি প্রকল্পের মধ্যে একটি প্রকল্প সরাসরি নারী ও শিশুদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ‘পরিবেশগত নাজুক এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ নারী-শিশুদের জন্য পানি সরবরাহ ও সামাজিক সুরক্ষা নামক একটি প্রকল্প মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধু ভোলা জেলায় বাস্তবায়ন করছে। ভোলার সঙ্গে খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাটসহ অন্যান্য উপকূলীয় জেলাতেও এই প্রকল্প চালু করা প্রয়োজন।’

বেলা শেষে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের বিলকিসের বিবর্ণ মুখ ভোলা কঠিন। ঘরের জন্য পানি সংগ্রহ করতে গিয়েছিল। নিজের গ্রাম চকবার থেকে হেঁটে হেঁটে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বুড়িগোয়ালিনিতে। বিলকিস একা নয়। নারী ও শিশুসহ প্রায় ২৫ জন অনেকে আবার ভ্যানগাড়ি করে যায়। বিলকিসও মাঝেমধ্যে ভ্যানগাড়িতে যায়। আজ বিলকিসকে হেঁটে যেতে হয়েছে। পানি নিয়ে ফিরে আসতে দ্বিপ্রহর হয়ে যায়। তাই আজ আর স্কুলে যাওয়া হলো না বিলকিসের। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কী কোনো উপায় নেই। ভাবনাটা সবার হলেও সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আশাকরি সরকার নিশ্চয়ই ইতিবাচক ভূমিকায় এগিয়ে আসবে- এটুকুই প্রত্যাশা।