করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। মা-বাবা অনেকটা নীরবে লুকিয়ে কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। শহরের তুলনায় গ্রামেই বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত জেলা এবং উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় বাল্যবিয়ে বেশি ঘটছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। প্রতিটি উপজেলায় চাইল্ড হেল্পলাইনের মোবাইল টিম আছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংস্থাটির কর্মীরা কাজ করছেন। এ ছাড়া সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এ হেল্পলাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছে। চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জানা যায়, এ সাহায্যকারী সংস্থার কাছে বাল্যবিয়ে সংক্রান্তকালের সংখ্যা আগের চেয়ে করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিয়ের সঙ্গে শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এমন কন্যাশিশুদের বাল্যবিয়ের হার বেশি। তবে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে এ হার অনেক কম। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, দারিদ্র্যের কারণে যেমন মেয়ের বাবা-মা শিশু বয়সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, তেমনি বিয়ের মাধ্যমে যৌতুক পাওয়ার আশায় অল্প বয়সি ছেলেকেও বিয়ে দিতে চায় অনেক বাবা-মা। এ ছাড়া মেয়ের নিরাপত্তার কারণেও অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয় বাবা-মা।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ শিশু-কিশোর। তার অর্ধেক কন্যাশিশু। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনো তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। দেশের শতকরা ৫২ ভাগ মেয়েকে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়া হয় আর ২২ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। অথচ বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৬টি লক্ষ্য এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে হলে বাল্যবিয়ে বন্ধের বিকল্প নেই।
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে ২০১৭-তে বলা হয়েছে, মেয়ের বয়স ১৮ ও ছেলের বয়স ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তাদের বিয়ে দেওয়া যাবে না। এ আইনটির বিষয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা রয়েছে। পাশাপাশি এর পরিণতি সম্পর্কেও অনেকের স্পষ্ট ধারণা তাদের নেই। তাই বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি সচেতন করতে হবে। এর শাস্তি সম্পর্কেও ব্যাপকভাবে জনগণকে জানাতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে কাজিদের বিয়ে পড়ানো বাধ্যতমূলক করতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি এবং মাঠ প্রশাসনের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করতে হবে।
২০১৮-২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ-সংক্রান্ত ন্যাশনাল অ্যাকশনপ্যান বাস্তবায়নে এবং করোনার কারণে কন্যাশিশু ও কিশোরীদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে চলতি অর্থবছরে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এবং জোর করে বিয়ে দেওয়া বন্ধ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। সে লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার।
তবে বর্তমানে গণমাধ্যমে বাল্যবিয়ে সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণার ফলে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বিবাহযোগ্য বয়সের আইনগত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত করা হচ্ছে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে মেয়েদের স্বাবলম্বী করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের এমনকি কাজিদেরও শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জড়িতদের তাৎক্ষণিক সাজা দিচ্ছে। কয়েক দিন আগে একজন কাজিকে বাল্যবিয়ে পড়ানোর দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব ব্যবস্থার বাল্যবিয়ে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে আশা করা যায়। এখন প্রয়োজন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে পুরুষদেরও সম্পৃক্ত করা।
বাল্যবিয়ে আমাদের সম্ভাবনাময় কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীব ধ্বংস করে দেয়। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ এবং যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করেছে। এ আইনে বাল্যবিয়ের শাস্তি হিসেবে কারাভোগের মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বছর এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সরকার প্রণীত শিশু আইন ২০১৩ ও জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি সবাই শিশু। তাই ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েকে বিয়ে দেওয়া দণ্ডণীয় অপরাধ। বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ নারী শিক্ষার প্রসার, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণসহ অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সরকার, এনজিও, সুশীলসমাজ ও সচেতন নাগরিকদের প্রচেষ্টায় এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তেমনিভাবে আমরা আশা করি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়েও এক দিন শতভাগ সফলতা আসবে। এজন্য আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বয়স প্রমাণে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা, বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর প্রভাবের ওপর লিফলেট বিতরণ, কমিনিটি রেডিওর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের জন্য সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার জোরদারকরণ, ইউনিয়নপর্যায়ে উঠান বৈঠক ইত্যাদির মাধ্যমে বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত প্রচারণা চালানো হলে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি হবে। বন্ধ হবে বাল্যবিয়ে, উজ্জ্বল হবে কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ।